পর্ব-১ | বিজয়ের দিনপঞ্জী (১ ডিসেম্বর ১৯৭১)

শুরু হয়েছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এরই মধ্য দিয়ে বিজয়ের ৪৮ তম বছরে পদার্পন করতে যাচ্ছে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবথেকে উজ্জ্বল ও ঘটনাবহুল এই মাসেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি পাকিস্তানের কাছ থেকে। দীর্ঘ ৯ মাসের ত্যাগ, তিতিক্ষা, লাখো শহীদের রক্ত পেছনে ফেলে ১৬ ডিসেম্বরে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। 

ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকেই মূলত সূচনা হয়  আত্মরক্ষার বদলে সরাসরি আক্রমনের। তাই এই দিনটিকে মুক্তিযোদ্ধারা পালন করে থাকেন মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসাবে। অগ্নিঝড়া ডিসেম্বরের শুরু থেকেই সর্বাত্মক রুপ নেয় মুক্তিযুদ্ধ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল গুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ এবং প্রতিরোধ। ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে পাক বাহিনীর প্রতিরোধ শক্তি। 

১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর আমেরিকার বিখ্যাত ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি রিপোর্ট করে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী সেনাবাহিনী আরো ভয়াবহ ভাবে নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে এই রিপোর্টে বলা হয়। সেনাবাহিনী বর্বরোচিত ভাবে হত্যা করতে থাকে গ্রামের সাধারণ মানুষদের। এদিন বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে জিঞ্জিরা নামক গ্রামের ৮৭ জন ব্যাক্তিকে একই সারিতে দাড় করিয়ে হত্যা করা হয় ।

অন্যদিকে এদিন পাকিস্তানের  রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র এই মর্মে বিবৃতি দেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারকার্য এখনো শেষ হয়নি । তারা চাচ্ছিল দ্রুত একটি প্রহসনের বিচার সম্পন্ন করে তার রায় কার্যকর করতে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় এই দুরভিসন্ধি ফলপ্রসূ হয়নি। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদে দেয়া এক বক্তব্যে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানকে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে  বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য আহবান জানান। 

১লা ডিসেম্বরে সিলেটের কানাইঘাটে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ জন পাকসৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়। পাক বাহিনী বড়লেখা ও জুড়ি এলাকা থেকে কামান সরিয়ে নেয়। বিপুল ক্ষতি স্বীকার করে পাকসেনারা কুলাউড়ার দিকে পালিয়ে যায়। শমসেরনগরে মুক্তিবাহিনী একটি দুর্বার আক্রমণ চালায় এবং তুমুল যুদ্ধের পর টেংরাটিলা ও দুয়ারাবাজার শত্রুমুক্ত করে দখল নিতে সক্ষম হয়। এরপর পলায়নপর পাকবাহিনীর ওপর গেরিলা হামলা চালাতে থাকে। একের পর এক গেরিলা আক্রমণের মুখে হানাদারবাহিনী সিলেটের আলীরগাঁও, পিরিজপুর ও গারা এলাকা থেকে শিবির গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। ছাতক শহরে প্রচন্ড যুদ্ধে ৬৫ জন রাজাকার নিহত হয়।সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার শত্রুমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগিয়ে যায়।
কুমিল্লায় কসবায় ভয়াবহ যুদ্ধে ৬০ এর অধিক পাকসেনা প্রাণ হারায়।
কুষ্টিয়ার দর্শনাতেও পাক বাহিনীর ওপর এদিন কঠিন আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনি। কুষ্টিয়ার কাছে মুন্সিগঞ্জ ও আলমডাঙা রেলস্টেশনের মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের মাইন বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয় পাক সৈন্যবাহী একটি ট্রেন এবং হতাহত হয় বহু সৈন্য।

ঢাকার মুক্তিযোদ্ধারা পিপলস পার্টির কার্যালয় এক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়। এই বিস্ফোরণের মাধ্যমে তারা নিজেদের অস্তিত্ব ও ক্ষমতা বিশ্ব দরবারে জানান দেয়। একইসাথে আতংক ধরিয়ে দেয় শত্রু শিবিরে। 
এদিন সাতক্ষীরা মহকুমার কালীগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান, অর্থ সচিব এ. জামান, আইজি এম.এ খালেক, তোফায়েল আহমেদ এবং ফণী মজুমদার কালীগঞ্জ পরিদর্শন করেন বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে।

১ ডিসেম্বর রাতে কর্নেল শফিউল্লাহ, ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর মঈন, এবং ১১ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর নাসিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাপুর, আজমপুর,গৈরালসানি, সিঙ্গারাইল ও মেরানি এলাকায় অপারেশন চালিয়ে শত্রুমুক্ত করে। এই যুদ্ধে মারা যায় ২৩ পাকসেনা। 

এছাড়া আরো কিছু ছোটখাটো সফল অপারেশন সংঘটিত হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বাংলাদেশ সরকার ঘোষনা দেয় খুলনা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর ও সিলেট জেলার ৬২টি থানা এবং নোয়াখালির সকল চরে বেসামরিক প্রশাসন স্থাপন করা হয়েছে। বেতারের মাধ্যমে এই সংবাদ গুলো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ফলে উজ্জীবিত হয় সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ জনগন। নতুন বিক্রমে তারা ঝাপিয়ে পড়তে থাকে পাকবাহিনীর ওপর। কোনঠাসা হয়ে পড়তে থাকে শত্রুরা।
এই সিরিজের বাকী পর্বগুলো পড়ুন
এখান থেকে >>>